দক্ষিণ চীন সাগরের ঢেউয়ে ভারতের বাড়তে থাকা প্রভাব

  • ডা. ময়ঙ্ক চতুর্বেদী

দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তাল জলে ভারতের পতাকা এখন কেবল সমুদ্রের হাওয়ায় নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোড়নেও উড়তে শুরু করেছে। বৃটেনে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী টেডোরো লক্সিন জুনিয়র সম্প্রতি ভারত-ফিলিপাইনসের প্রথম যৌথ নৌসেনা মহড়ার পর যে খোলামেলা ভঙ্গিতে ভারতীয় নৌসেনার প্রশংসা করেছেন, তা শুধু একটি কূটনৈতিক উক্তি নয়। এটি সেই বদলে যাওয়া সামরিক সমীকরণের ইঙ্গিত, যেখানে ভারত এখন এক সাহসী সমুদ্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। লক্সিনের এই মন্তব্য যে, “ভারতীয় নৌসেনা একমাত্র সেই নৌসেনা যে যেখানে যেতে চায়, সেখানে যায়” সরাসরি সেই আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক, যা ভারত গত এক দশকে “ইন্দো-প্রশান্ত” অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছে।

এই মন্তব্য এমন এক সময় এসেছে যখন ফিলিপাইনের জলসীমায় উত্তেজনা চরমে। সম্প্রতি স্কারবোরো শোলের কাছে ফিলিপাইনের উপকূলরক্ষী বাহিনীর এক নৌকাকে হয়রানি করতে গিয়ে চীনের নৌসেনা ও উপকূলরক্ষীর জাহাজ নিজেরাই একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। এই ঘটনা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বাড়তে থাকা আগ্রাসন ও তার ফলাফলের স্পষ্ট উদাহরণ। ফিলিপাইনের বিআরপি সুলুয়ান জাহাজ সেখানে ছিল জেলেদের সহায়তা ও সরবরাহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু চীনের “সামরিক জবরদস্তি” নীতির কারণে সেখানে চীনা জাহাজের আসা-যাওয়া নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত ও ফিলিপাইনের যৌথ নৌমহড়া এক সাহসী বার্তা নিয়ে এসেছে যে দক্ষিণ চীন সাগর আর কেবল চীন ও তার দাবির খেলার মাঠ হয়ে থাকবে না।

দক্ষিণ চীন সাগর, এশিয়ার সেই সামরিক ফ্রন্ট যেখানে ভূগোল, সম্পদ ও শক্তিরাজনীতি—এই তিনেরই মিলন ঘটে। এখানে প্রতি বছর প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক মালামাল যাতায়াত করে। শক্তির বিশাল ভাণ্ডার, সমৃদ্ধ মৎস্যসম্পদ এবং কৌশলগত সমুদ্রপথ একে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের কেন্দ্র বানিয়েছে। চীন “নয়-ড্যাশ রেখা”র নামে গোটা অঞ্চলের উপর ঐতিহাসিক অধিকার দাবি করে, অথচ ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও তাইওয়ানও তাদের নিজ নিজ অংশের দাবি করে। আমেরিকা ও তার মিত্ররা এই অঞ্চলে “নৌপরিবহণের স্বাধীনতা”র নামে নৌগশ্ত চালালেও তারা চীনের সংবেদনশীল এলাকায় সরাসরি সংঘাতে যেতে এড়িয়ে চলে। এর বিপরীতে, ভারত গত কয়েক বছরে তার যুদ্ধজাহাজ ও সরবরাহ জাহাজের মাধ্যমে বারবার প্রমাণ করেছে যে, সে যেকোনো সমুদ্রসীমায়, তা চীনের দাবির ভেতরেই হোক না কেন, তার মিত্র দেশের পাশে দাঁড়াবে।

ভারত ও ফিলিপাইনের এই প্রথম নৌমহড়া কেবল প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সূচনা নয়, বরং এটি এক কৌশলগত “ঘোষণা”। ভারতের “পূর্বমুখী নীতি” এখন “দৃঢ় পূর্বমুখী নীতি”য় পরিণত হচ্ছে। এই পরিবর্তন কেবল নীতিগত রদবদল নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার ফল। চীনের আগ্রাসী মনোভাব আর আমেরিকার দ্বিধার মাঝখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এমন এক অংশীদার খুঁজছে, যে শুধু পাশে দাঁড়াবে না, প্রয়োজনে মাঠেও নামবে। ভারত এই ভূমিকায় পুরোপুরি মানানসই—তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি এবং শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা দিয়ে।

লক্সিনের মন্তব্যে পশ্চিমা দেশগুলোর নৌসেনাদের দিকেও বিদ্রূপ ছিল। “খোজা” শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন কেবল রসিকতার জন্য নয়, বরং দেখানোর জন্য যে পশ্চিমা শক্তিগুলো আওয়াজ তো তোলে, কিন্তু বাস্তবে চীনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে। এর বিপরীতে, ভারত কোনো আনুষ্ঠানিক সামরিক জোট ছাড়াই সেখানে পৌঁছে যায়, যেখানে তার বন্ধুর প্রয়োজন হয়। এ কারণেই লক্সিন খোলাখুলিভাবে বলেছেন, ফিলিপাইনের সাহস তার শক্তি, কিন্তু এই গশ্তে যোগ দেওয়ার সাহস কেবল ভারতীয়দের আছে।

ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ভারত-ফিলিপাইনস সম্পর্ক কেবল আজকের কৌশলের ফল নয়। দুই দেশ ১৯৫০ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। তখন থেকেই সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক ক্রমশ এগিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ফিলিপাইনস ভারত থেকে ব্রহ্মোস অতিস্বনক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে, যা চীনের সামুদ্রিক ঘাঁটিতে দ্রুত ও নিখুঁত আঘাত হানতে সক্ষম। এই চুক্তি কেবল সামরিক ক্ষমতা বাড়ানোর নয়, বরং দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্বেরও প্রমাণ।

লক্সিনের “উউন্ডেড নি হত্যাকাণ্ড”র প্রসঙ্গও গভীর বার্তা বহন করে। এটি ১৮৯০ সালের সেই ঘটনা, যখন আমেরিকান সেনারা দক্ষিণ ডাকোটায় লাকোটা সিউক্স জনগোষ্ঠীর ১৫০ থেকে ৩০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। এদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও ছিল। লক্সিন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আমেরিকার ইতিহাস তার সহযোগী ও আদিবাসীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এবং আজও তার পররাষ্ট্রনীতিতে সেই প্রবণতা দেখা যায়। এই মন্তব্য পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেয় যে ফিলিপাইনসের মতো দেশগুলো আমেরিকার উপর অন্ধভাবে নির্ভর করতে পারে না এবং ভারতের মতো দেশ তাদের জন্য অনেক বেশি বিশ্বস্ত অংশীদার হতে পারে।

ভারতের সামুদ্রিক কৌশল এখন ভারত মহাসাগর ছাড়িয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। এটি কেবল সামরিক উপস্থিতি নয়, বরং এক “নিরাপত্তা প্রদানকারী নেটওয়ার্ক”র ভূমিকা। এর মানে ভারত শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষা করছে না, বরং মিত্র দেশগুলোর সামুদ্রিক নিরাপত্তারও দায়িত্ব নিচ্ছে। বলতে হবে, এই ভূমিকা পালন করা সহজ নয়—এতে নৌসেনার সক্ষমতা, অর্থনৈতিক সম্পদ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা—এই তিনেরই প্রয়োজন হয়। গত এক দশকে ভারত এই তিন ক্ষেত্রেই তার প্রস্তুতি প্রমাণ করেছে।

আসলে টেডোরো লক্সিনের এই মন্তব্য সেই বিশ্বাসের প্রকাশ, যা ভারত তার আচরণ ও নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতের উপস্থিতি এখন আর কেবল প্রতীকী নয়, বরং চূড়ান্ত। তার এই উপস্থিতি আগামী দিনে ফিলিপাইনসই নয়, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর জন্যও অনুপ্রেরণা হতে পারে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর দ্বিধার মাঝখানে ভারতের এই আত্মবিশ্বাস আগামী বছরগুলোতে এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের শক্তিসাম্যকে নতুন দিশা দিতে পারে। যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো কৌশলগত দলিল ও বক্তব্যে আটকে আছে, সেখানে ভারত ঢেউয়ের উপর নিজের পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছে—কখনো মিত্র দেশের তটে, তো কখনো বিতর্কিত জলসীমার মাঝখানে।

আজ এটি শুধু এক নৌসেনার গল্প নয়, বরং এমন এক দেশের কাহিনী, যে এখন বিশ্বমঞ্চে নিজের জায়গা নিজেই নির্ধারণ করছে। আর এ কারণেই দক্ষিণ চীন সাগরের ঢেউয়ে আজ ভারতীয় নৌসেনার নাম সাহস ও বিশ্বাসের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই দিকটিতে ভারতকে যে পদক্ষেপ নিতে হবে, তার মধ্যে প্রধান হবে—ভারত-ফিলিপাইনস সহযোগিতার অন্তর্গত নিয়মিত যৌথ গশ্ত, সামুদ্রিক নজরদারি ভাগাভাগি করা, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ। এই তিনটি পদক্ষেপই দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতের উপস্থিতিকে স্থায়ী করতে পারে। এর বাইরে, আসিয়ান মঞ্চে এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর উদ্যোগে দুই দেশ একসঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো মজবুত করতে পারে। চীনের জন্য এটি এক স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ হবে। ভাল দিক হলো, এই চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন এবং “নৌপরিবহণের স্বাধীনতা”র নীতির উপর ভিত্তি করে হবে, যা ভারতকে বৈধতা ও নৈতিক উচ্চতা দুটোই প্রদান করবে।

Read More News

মজবুত ভারত, বুলন্দ ইরাদে

সকাল সকাল ডেস্ক। -ঋতুপর্ণ দেবে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে টানা ১২তম বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর...

Read More