- ড. নিবেদিতা শর্মা
ভারত আজ সেই ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে তার দিকনির্দেশ সরাসরি বৈশ্বিক মহাশক্তি হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে গত পঁচাত্তর বছরে দেশ নানান উত্থান-পতন দেখেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেভাবে ভারত তার অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক সক্ষমতাকে পরিপক্ব করেছে, তা যে কোনও জাতির জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ। স্বাধীনতা দিবসের উপলক্ষে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘোষণাটি এই যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ কড়ি। প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা কেবল একটি নীতিগত উদ্যোগ নয়, বরং এটি সেই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির অংশ যার অধীনে ভারতকে আত্মনির্ভর, শক্তিশালী এবং সুযোগে পরিপূর্ণ সমাজ হিসেবে গড়ার সংকল্প নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা প্রতিফলিত করে সেই বিশ্বাস যে, ভারতের ভবিষ্যৎ নিহিত আছে তার যুবসমাজের মধ্যে। এই বিশ্বাসই আমাদের সেই লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যাবে যেখানে ভারত শুধু তার নাগরিকদের জন্য সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে না, বরং বিশ্বকেও শান্তি, অগ্রগতি ও মানবিক মূল্যের দিশা দেখাবে।
এই যোজনা ১ লক্ষ কোটি টাকার ব্যয়ে কার্যকর করা হচ্ছে এবং এর আওতায় আগামী দুই বছরে ৩.৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম দর্শনে এই ঘোষণা হয়তো একটি সরকারি কর্মসূচি মনে হতে পারে, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় যে এটি ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি, তার সামাজিক কাঠামো এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কারণ, কোনও দেশের মহাশক্তি হওয়ার পথ তার যুবসমাজের হাত দিয়েই অতিক্রান্ত হয়। যুবকদের জন্যও এটি একটি সুযোগ, যেখানে তাদের সামাজিক নিরাপত্তার সুরক্ষা-কবচ দেওয়া হচ্ছে। তাদের শ্রম যদি যথাযথ মর্যাদা পায়, তবে কেবল তাদের ব্যক্তিগত সমৃদ্ধিই নয়, বরং জাতির সমষ্টিগত উন্নয়নও নিশ্চিত হয়।
আজ ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি এবং নীতিগত পূর্বাভাস অনুযায়ী খুব শিগগিরই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। এটি কেবল পরিসংখ্যানের খেলা নয়, বরং এই সত্যের প্রমাণ যে ভারতের উৎপাদন, তার রপ্তানি, তার সেবা-ক্ষমতা এবং তার অভ্যন্তরীণ বাজার অভূতপূর্ব সম্প্রসারণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন সময়ে যখন পশ্চিমা দেশগুলির অর্থনীতি মন্দার সঙ্গে লড়ছে, ভারতের প্রবৃদ্ধি হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, বিশ্বের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ইঞ্জিন আজ ভারত।
এর পাশাপাশি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং বৈশ্বিক ভাবমূর্তিও আজ এমন যে, তা আমাদের মহাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করছে। আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানের মতো উন্নত দেশ ভারতকে তাদের নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখছে। ব্রিকস ও জি-২০–এর মতো মঞ্চে ভারতের নেতৃত্বদায়ক ভূমিকা স্পষ্ট। প্রতিরক্ষা উৎপাদন, মহাকাশ প্রযুক্তি, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সবুজ জ্বালানির মতো ক্ষেত্রে ভারত যে অগ্রগতি করেছে, তা আগামী বছরগুলোতে বিশ্বকে পথ দেখাবে। এমন পরিস্থিতিতে যদি দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামো, বিশেষ করে কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো আরও শক্তিশালী হয়, তবে ভারতের জন্য বৈশ্বিক মহাশক্তি হওয়ার পথ আরও সহজ হবে।
বর্তমানে যা প্রতীয়মান হচ্ছে, তার আলোকে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তার মধ্যে এই বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা ভারতের উন্নয়নকে সমাজের আরও গভীরে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হবে। এর ‘এ’ অংশ সরাসরি সেই যুবকদের লক্ষ্য করছে, যারা প্রথমবার কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। যারা সদ্য পড়াশোনা শেষ করে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করছে, তাদের দু’কিস্তিতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রोत्सাহনমূলক অনুদান দেওয়া হবে। এটি শুধু তাদের আর্থিক চাপ লাঘব করবে না, বরং তাদের আর্থিক সাক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কেও সচেতন করবে। এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের দেশে অনেক যুবক চাকরি পেলেও সঞ্চয় ও বিনিয়োগের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে না। এই অনুদানের একটি অংশ সঞ্চয়ী হিসাবে জমা রাখা বাধ্যতামূলক হবে, যাতে তাদের মধ্যে আর্থিক শৃঙ্খলার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
যোজনার দ্বিতীয় অংশটি নিয়োগকারীদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য। যতদিন শিল্প ও পরিষেবা খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে না, ততদিন যুবকদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, নিয়োগকারীদের ওপর চাপ কমাতে তারা প্রস্তুত। যদি কোনও কোম্পানি নতুন কর্মী নিয়োগ করে এবং তার বেতন এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়, তবে সরকার দুই বছর ধরে প্রতি কর্মীর জন্য মাসিক তিন হাজার টাকা ভর্তুকি দেবে। উৎপাদন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এই প্রণোদনা চার বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটি স্পষ্ট করে যে ভারত কেবল পরিষেবা খাতে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বরং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযানে গতি এনে উৎপাদন খাতকেও অর্থনীতির মেরুদণ্ড বানাতে চায়।
আজ দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্র সরকারের বেশিরভাগ বড় পরিকল্পনাই তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। জনধন যোজনা, উজ্ব্বলা, আয়ুষ্মান ভারত, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া এবং উৎপাদন-সংক্রান্ত প্রণোদনা (পিএলআই) তার উদাহরণ। এই পরিকল্পনাগুলো সমাজ ও অর্থনীতিতে রূপান্তর এনেছে। তাই বিকশিত ভারত রোজগার যোজনার ক্ষেত্রেও আশা করা হচ্ছে যে এটি শুধুই ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং যুবকদের বাস্তব সুযোগ করে দেবে। তাই বলা ভুল হবে না যে এই যোজনার প্রভাব ভারতের সামাজিক কাঠামোর ওপরও পড়বে।
প্রকৃতপক্ষে এটিও একটি সত্য যে আমাদের দেশে আজও অসংগঠিত খাতের অংশ অত্যন্ত বড়। বিপুল সংখ্যক মানুষ কোনও সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াই অস্থায়ী কাজে নিযুক্ত। কিন্তু এই যোজনা সরাসরি ইপিএফও–তে নিবন্ধিত কর্মী এবং প্যান–লিঙ্কড হিসাবযুক্ত নিয়োগকারীদের লক্ষ্য করছে। এর মানে হলো, কোটি কোটি যুবক ও লক্ষ লক্ষ প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ হবে। আর যখন কর্মশক্তি আনুষ্ঠানিক হয়, তখন তারা স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন, ভবিষ্যৎনিধি ও অন্যান্য সুবিধা পায়। এতে সমাজে বৈষম্য কমে এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিস্তার ঘটে।
ভারতের মহাশক্তি হওয়ার পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার জনসংখ্যা-গঠন। আজ ভারতের অর্ধেকের বেশি মানুষ ৩০ বছরের কম বয়সী। এই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ আমাদের জন্য যেমন সুযোগ, তেমনি চ্যালেঞ্জও। যদি এই যুবকদের যথাযথ শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান দেওয়া যায়, তবে তারা শুধু ভারতের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে না, বরং বিশ্বজুড়েও ভারতীয় দক্ষতার ছাপ ফেলবে। কিন্তু যদি এই যুবকরা বেকারত্ব ও হতাশার শিকার হয়, তবে সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা সময়োপযোগী এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ। এই যোজনা ভারতের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তব রূপ দেয়, যেখানে প্রতিটি যুবক কেবল চাকরিই নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সুযোগ পায়।
No Comment! Be the first one.