মজবুত ভারত, বুলন্দ ইরাদে

সকাল সকাল ডেস্ক।

-ঋতুপর্ণ দেবে

লালকেল্লার প্রাচীর থেকে টানা ১২তম বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বাধীনতা দিবসের এবারের ভাষণ কিছুটা আলাদা এবং নানা ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল। তাঁর ১০৩ মিনিটের বক্তব্য কেবলমাত্র এতদিনের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘই নয়, বরং কঠিন ও স্পষ্ট সংকল্প প্রদর্শনকারীও বটে। এটি কূটনীতির দিক থেকেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। যেখানে শুরুতেই অনুচ্ছেদ ৩৭০ অপসারণ করে এক দেশ, এক সংবিধানের কথা বলেন। সেখানে অপারেশন সিন্দূরের প্রসঙ্গ তুলে সেনাকে উন্মুক্ত অনুমতি দেওয়ার সত্যও সামনে রাখেন। আসলে, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বহু দিক থেকেই ভিন্ন, কঠিন এবং বিশ্বের জন্য কূটনৈতিক বার্তার মতো ছিল। পাশাপাশি দেশের ভেতরেও ঘটতে থাকা অগ্রহণযোগ্য ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তাও ছিল। এর বাইরে দেশের অগ্রগতি, যুবকদের প্রেরণা, সাফল্য এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মিশনে ভারতের অবদানকেও কেন্দ্র করে ছিল। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত এমন কোনও বিষয়ই বাদ রাখেননি, যা জরুরি ছিল না। ইশারায় যেখানে আমেরিকা ও চীনকে তার আসল অবস্থান মনে করিয়ে দেন, সেখানেই পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে তীব্র আক্রমণ করেন।

প্রথমে জানা যাক তিনি কী কী বলেছেন। পাহালগাঁও হামলার প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে একহাতে নিয়ে তাঁদের সন্ত্রাসী হেডকোয়ার্টার ধ্বংস করার কথা বলে পাকিস্তানের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার কথাও বলেন। দীর্ঘদিনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেলের সামনে নতি স্বীকার করবেন না এবং সেনার শর্তে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার কথাও বলেন। পুরনো সিন্ধু জল চুক্তিকে অন্যায্য বলে উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলেন, ভারতের নদী কি শত্রুর খেত সিঞ্চন করবে আর দেশের কৃষকের জমি তৃষ্ণার্ত থাকবে? সিন্ধু চুক্তির ওই রূপ আর মেনে নেওয়া হবে না বলেও স্পষ্ট জানান।

২১শ শতক প্রযুক্তিনির্ভর শতক। ৫০–৬০ বছর আগে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে চিন্তা হলেও ফাইল সেখানেই আটকে যায়। সেমিকন্ডাক্টরের চিন্তার ভ্রূণহত্যা হয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক দেশ সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষতা অর্জন করে বিশ্বকে তাদের শক্তি দেখিয়েছে। মিশন মোডে এ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও ৬টি ভিন্ন সেমিকন্ডাক্টর ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনার মধ্যে চারটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান। চলতি বছরের শেষে মেড ইন ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারতেই তৈরি চিপ বাজারে আসা এক বিশাল সাফল্য হবে।

প্রধানমন্ত্রী আরও অনেক পরিকল্পনা ও সাফল্যের কথাও তোলেন। ১১ বছরে সোলার এনার্জির ব্যবহার ৩০ গুণ বৃদ্ধি, নতুন নতুন ড্যাম তৈরি করে জল শক্তির প্রসার ঘটানো, ক্লিন এনার্জির দিকে অগ্রসর হওয়া, ১০টি নতুন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দ্রুত কাজ করছে। ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গঠনের লক্ষ্য যাতে স্বাধীনতার ১০০ বছরে ভারতের পারমাণবিক শক্তি ক্ষমতা ১০ গুণেরও বেশি হয়।

তিনি বলেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবিলায় নির্ধারিত সময় ২০৩০–এর আগে ৫ বছরেই ৫০ শতাংশ ক্লিন এনার্জির লক্ষ্য অর্জন করা আমাদের প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীলতার প্রমাণ। ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল মিশন চালু করে ১২০০–রও বেশি স্থানে অনুসন্ধান অভিযানের মাধ্যমে আমরা ক্রিটিক্যাল মিনারেলেও আত্মনির্ভরতার দিকে এগোচ্ছি, যা বিরাট অর্জন। যুব সমাজকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের নিজস্ব মেড ইন ইন্ডিয়া ফাইটার জেটের জন্য জেট ইঞ্জিনও কি আমাদের হওয়া উচিত নয়? আমরা ‘ফার্মা অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। এখন সময় এসেছে গবেষণা ও উন্নয়নে আরও শক্তি লাগানোর। আমাদের নিজস্ব পেটেন্ট হওয়া উচিত। মানবকল্যাণে সস্তা, সবচেয়ে কার্যকর ও নতুন ওষুধে গবেষণা হওয়া চাই। সঙ্কটকালে যাতে কোনও সাইড ইফেক্ট ছাড়াই জনকল্যাণে কাজে লাগে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী আহ্বান করেন যে এটি আইটির যুগ, ডেটাই শক্তি। সময়ের দাবি নয় কি যে অপারেটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে সাইবার নিরাপত্তা, ডিপ টেক থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পর্যন্ত সবকিছু আমাদের নিজস্ব হোক? নিজেদের সামর্থ্য ও শক্তিকে বিশ্বের সামনে পরিচিত করিয়ে বলেন, আমাদের ইউপিআই বিশ্বকে বিস্মিত করছে। রিয়েল টাইম ট্রানজ্যাকশনের ৫০ শতাংশ একা ভারতই ইউপিআইয়ের মাধ্যমে করছে। ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ল্ড, সোশ্যাল মিডিয়া—এতসব প্ল্যাটফর্ম কেন আমাদের নিজস্ব হবে না? কেন ভারতের অর্থ বাইরে যাবে? আমি যুবকদের সামর্থ্যের উপর আস্থা রাখি।

প্রধানমন্ত্রী ইভি ব্যাটারি, সোলার প্যানেল, মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মানসম্মত পণ্যের পরিচিতির পাশাপাশি নেক্সট জেনারেশন রিফর্মসের জন্য টাস্ক ফোর্স গঠন ও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করার কথা বলেন, যাতে বর্তমান আইন, নীতি, প্রথা ২১শ শতক ও বৈশ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় এবং ২০৪৭ সালে ভারতকে উন্নত দেশ করে তুলতে পারে। নেক্সট জেনারেশন জিএসটি সংস্কারকে দীপাবলির উপহার বলে উল্লেখ করে জানান, মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসে আরোপিত ভারী কর অনেকটা কমে যাবে, এমএসএমই, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা লাভবান হবে এবং দৈনন্দিন পণ্য সস্তা হয়ে অর্থনীতিকে নতুন বল দেবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, ভেবেচিন্তে সাজানো চক্রান্তের মাধ্যমে দেশের ডেমোগ্রাফি বদলকে নতুন সঙ্কট বলে উল্লেখ করেন। অনুপ্রবেশকারীরা দেশের যুবকদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, বোন–বেটিদের টার্গেট করছে। এটা সহ্য করা হবে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা ত্যাগ ও আত্মবলিদানের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। একটি হাই পাওয়ার ডেমোগ্রাফি মিশন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা এমন ভয়ঙ্কর সঙ্কট মোকাবিলায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করবে। আমরা সে পথে এগোচ্ছি।

এবারের ভাষণ থেকে এতটুকু স্পষ্ট হয়ে গেল যে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চেয়ে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলার সংকল্প দেশবাসীর সামনে রেখেছেন। ব্ল্যাকমেল সহ্য নয়, অপারেশন সিন্দূরের উল্লেখ, স্বদেশীকে ‘মজবুরি নয়, মজবুতি’ হিসেবে তুলে ধরা—এর সঙ্গে পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে এবং আমেরিকাকে ইশারায় সতর্কও করেছেন। প্রথমবার লালকেল্লা থেকে জাতীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ১০০ বছরের জাতিসেবা উল্লেখ করা এবং মা ভারতীর কল্যাণের লক্ষ্যে সেবা, সমর্পণ, সংগঠন ও অতুলনীয় শৃঙ্খলার প্রসঙ্গ তুলে আরএসএসকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও বলে আখ্যা দেওয়া এবং জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ আনার রাজনৈতিক তাৎপর্যও বেরোবে। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদী ১২তম বার সবচেয়ে দীর্ঘ, ১০৩ মিনিট বক্তব্য রেখে বিশ্বকে নিজের সংকল্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখন সময় পক্ষ–বিপক্ষের, যারা তাঁর ভাষণের নিজ নিজ মতানুযায়ী নানা ব্যাখ্যা ও অর্থ বার করবে।

Read More News

মজবুত ভারত, বুলন্দ ইরাদে

সকাল সকাল ডেস্ক। -ঋতুপর্ণ দেবে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে টানা ১২তম বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর...

Read More