সকাল সকাল ডেস্ক।
উজ্জ্বল কুমার দত্ত
(শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক)
কুমারডুবি, ঝাড়খন্ড।
আজকের দিনটি যেন ঝাড়খণ্ডের মাটি জুড়ে দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠেছে। ২০২৫ সালের ৪ঠা আগস্ট সকালে, ভারতের এক সংগ্রামী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। রাজধানী দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক, তিনবারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ শিবু সোরেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একাশি বছর। পুত্র হেমন্ত সোরেন তাঁর শোকবাণীতে যেন কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে বললেন—"আজ আমি শূন্য হয়ে গেলাম, দিশোম গুরু আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।" এই 'শূন্যতা' শুধুমাত্র পিতৃবিয়োগের নয়, বরং এক সংগ্রামী আদিবাসী স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার।
শিবু সোরেনের জীবন কাহিনী শুধু রাজনীতির অঙ্কের খতিয়ান নয়, এটি মাটি, মানুষ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক জীবন্ত রূপকথা। ১৯৪৪ সালের ১১ই জানুয়ারি, রামগড় জেলার নেমরা গ্রামের এক সাঁওতাল পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ছোটবেলায় পিতার মৃত্যু, জমিদারী শোষণের নির্মমতা এবং সামাজিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা তাঁকে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি করেছিল। এই দহন থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক দ্রোহের অগ্নিশিখা, যা তাঁকে পরিণত করেছিল দিশোম গুরু—অর্থাৎ জাতির গুরু হিসেবে।
১৯৭২ সালে শিবু সোরেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয়, বরং আদিবাসী স্বপ্ন, অধিকার, ভাষা এবং সংস্কৃতির রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছিল। দুমকা লোকসভা আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তিনি দিল্লির রাজনীতির অভিজাত গণ্ডিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁর জন্য রাজনীতি কখনোই কেবল ভোট ও ক্ষমতার খেলা ছিল না; বরং গ্রামগঞ্জের বঞ্চিত মানুষদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরাই ছিল তাঁর ব্রত। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনবার শপথ গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, দলীয় ভেদাভেদ এবং দিল্লির শাসকশক্তির দাদাগিরির কারণে তিনি একবারও পূর্ণ মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেননি।
কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বে থেকে যখন তিনি শিল্পপতিদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখনও তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট—মাটি ও খনিজ সম্পদের উপর স্থানীয় অধিকারকে নিশ্চিত করা। যদিও তাঁর রাজনৈতিক জীবন বারবার বিতর্ক, মামলা ও সংকটে জর্জরিত হয়েছে, তথাপি তিনি আপোস করেননি নিজের আদর্শের সঙ্গে। তাঁর রাজনীতি ছিল, "যেখানে মানুষ শোষিত হবে, সেখানেই প্রতিবাদের মশাল জ্বলবে।"
জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কিডনি জনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এক মাসেরও বেশি সময় ভেন্টিলেটরে থেকে, মৃত্যুর সঙ্গে এক অসম লড়াই লড়ে শেষ পর্যন্ত ৪ঠা আগস্ট সকালে তিনি চিরবিদায় নিলেন। শিবু সোরেনের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই গোটা ঝাড়খণ্ডের জনপদ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তাঁর জন্মভূমি থেকে শুরু করে রাজধানী দিল্লি পর্যন্ত রাজনৈতিক মহল, সাধারণ মানুষ এবং আদিবাসী সমাজ তাঁকে হারিয়ে যেন নিঃশব্দে কাঁদছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শোকবার্তায় শিবু সোরেনকে 'ভূমিপুত্র' এবং 'আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অগ্রণী সৈনিক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সত্যিই, শিবু সোরেনের নাম শুধু একটি রাজনৈতিক পরিচিতি নয়; বরং তাঁর নাম উচ্চারণ মানেই এক সংগ্রাম, এক আত্মবিশ্বাস, এক অনমনীয় মনোভাবের ইতিহাস।
তাঁর পুত্র হেমন্ত সোরেন বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। শিবু সোরেনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে হেমন্ত তাঁর বাবার আদর্শকে সামনে রেখে রাজ্য পরিচালনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দিশোম গুরু শিবু সোরেনের মতো ব্যক্তিত্বের বিকল্প কোনোদিনই হয় না। শিবু সোরেন ছিলেন এক চলমান প্রতীক, যিনি শুধুমাত্র মাটি, খনিজ সম্পদ কিংবা ভোটের রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি আদিবাসী সমাজের আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা ছিলেন।
আজ যখন শিবু সোরেন চিরনিদ্রিত অবস্থায় শায়িত পরপরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন, তখন ঝাড়খণ্ডের মাটিও যেন কেঁদে উঠছে। তাঁর সৃষ্টি করা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, তাঁর আদর্শ, তাঁর সংগ্রাম আজও শত শত তরুণ-তরুণীর মনে আগুনের মতো জ্বলছে। দিশোম গুরু শিবু সোরেন হয়তো শারীরিকভাবে আজ নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর লড়াই, তাঁর স্বপ্ন চিরন্তন।
এখন প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে তাঁর মৃত্যু কি শুধুই এক ব্যক্তির মৃত্যু, নাকি একটি আদিবাসী জাতিসত্তার রাজনীতির এক অধ্যায়ের সমাপ্তি? উত্তর হয়তো সময় দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়—শিবু সোরেন ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন; মাটির ঘ্রাণে, লড়াইয়ের গর্জনে, আর এক জাতির অস্তিত্বের মূলমন্ত্রে।
No Comment! Be the first one.