কর্তব্য ভবনঃ সংকল্প থেকে সিদ্ধির পথে

সকাল সকাল ডেস্ক।


– শ্যাম জাজু

ভারতের জনমানসে “কর্তব্য”র ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই কর্তব্যের আদর্শে গভীরভাবে নিহিত। ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের রাষ্ট্রের প্রতি নিষ্ঠা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, আচার্য চাণক্যের অনন্য রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, সম্রাট অশোকের ধর্মপ্রচার, গুপ্ত বংশের জ্ঞান ও ঐশ্বর্যের স্বর্ণযুগ, চোল সাম্রাজ্যের সামুদ্রিক শক্তির কাহিনি এবং ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের লোকহিতকর শাসন—এসবই ভারতীয় পরম্পরার অমর মহিমা। আজ সেই মূল্যবোধ আধুনিক রূপে প্রতিফলিত হচ্ছে ‘‘কর্তব্য ভবন’’ নামের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর দিল্লিতে ভাড়া করা বিভিন্ন ভবনে চলছিল, যা কেবল এক অস্থায়ী ব্যবস্থা ছিল। কত বছর আর আমরা ভাড়াবাড়ি চালাব? একদিন আমরা স্থির করি—“আমাদের নিজের বাড়ি চাই।” কেন্দ্র সরকারের ক্ষেত্রে সেই পদক্ষেপই হলো ‘‘কর্তব্য ভবন’’। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, সরকার প্রতিবছর লুটিয়েন্স জোন ও দিল্লির আশপাশের এলাকায় ভাড়ার ভবনের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে। কেবল ভাড়াতেই ১১০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা, তার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে আরও ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু ভবন ব্যবহারের পেছনেই খরচ হতো। এখন সব অফিস ‘‘কর্তব্য ভবন’’-এ স্থানান্তরিত হবে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ০৬ আগস্ট ‘‘কর্তব্য ভবন’’-এর উদ্বোধন করেছেন। এর আগে রাজপথকে ঔপনিবেশিক দাসত্বের প্রতীক মনে করে তার নাম পরিবর্তন করে ‘‘কর্তব্য পথ’’ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি, তিনিই এই ‘‘কর্তব্য ভবন’’-এর ভাবনা দিয়েছিলেন এবং তা বাস্তবায়নও করেছেন। ‘‘কর্তব্য ভবন’’র ধারণা শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নির্মাণের প্রকল্প নয়, বরং এটি ভারতের আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক। যেমন প্রতিটি পরিবার নিজের বাড়িকে স্বপ্ন ও নিরাপত্তার প্রতীক মনে করে, তেমনই রাষ্ট্রেরও নিজস্ব গৃহ থাকা প্রয়োজন। এটাই হবে সেই গৃহ, যেখানে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে নয়, জনগণের বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে উঠবে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও পদক্ষেপটি সুদূরদর্শী, কারণ অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এর খরচ উঠে আসবে। তবে এর আসল মূল্য সেই মানসিক শক্তিতে, যা এটি আগামী প্রজন্মকে দেবে। এই ভবন আমাদের গণতন্ত্রের আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব রূপ হবে, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে দ্রুত, স্বচ্ছ ও দৃঢ়ভাবে। বাস্তবিক অর্থে এটি শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং প্রতিটি ভারতীয়র আত্মমর্যাদা ও সংকল্পের গৃহ হবে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত, শক্তিশালী যোগাযোগ কার্যকর কর্মপদ্ধতি
‘‘কর্তব্য ভবন’’ হবে সেই স্থান, যেখানে প্রশাসন একত্রে বসবে, চিন্তা করবে ও কাজ করবে—ফলে যোগাযোগ সহজ হবে এবং দায়বদ্ধতা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এখন পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর দিল্লির নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল—নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, শাস্ত্রী ভবন, নির্মাণ ভবন, শিল্প ভবন, কৃষি ভবন, রেল ভবন ইত্যাদি। এগুলো শুধু আলাদা ঠিকানাই ছিল না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণও ছিল। এক মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া নীতি প্রণয়ন করতে পারে না। নীতি-প্রক্রিয়ায় সমন্বয় ও চিন্তার আদান-প্রদান অপরিহার্য। এখন সব একত্রিত হওয়ার ফলে এটি কয়েক মিনিটেই সম্ভব হবে। মিটিংয়ের জন্য আসা-যাওয়ার সময় বাঁচবে। শুধু সময়ই নয়, শক্তি, অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদও সাশ্রয় হবে। যেখানে মন্ত্রণালয়গুলি পাশাপাশি অবস্থান করে, সেখানে ‘সমস্যা’র চেয়ে ‘সমাধান’ দ্রুত পাওয়া যায়।

প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এটি হবে এক ডিজিটালফার্স্ট অবকাঠামো। সব মন্ত্রণালয়ের নেটওয়ার্কিং, ক্লাউড-ভিত্তিক ফাইল, সুরক্ষিত যোগাযোগ মাধ্যম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিক্স নীতি-প্রণয়নকে দ্রুত করবে। ‘‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’’-র স্লোগান বাস্তবায়িত হবে। নাগরিকরাও এর সুফল পাবেন। যখন সব এক স্থানে হবে, প্রশাসনিক কাঠামো আরও কার্যকরভাবে চলবে। এর প্রত্যক্ষ উপকার হলো—এক আধুনিক সরকারি ভবন, পরিবেশ-সচেতনতা ও ভারতীয় বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া।

ভবন, পার্কিং, আধুনিকতা পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি
‘‘কর্তব্য ভবন’’ শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি ২১শ শতাব্দীতে ভারতের কর্মসংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। নতুন এই কমপ্লেক্সে প্রায় ১৫০০ চারচাকা ও হাজারো দুইচাকার জন্য বহুস্তরবিশিষ্ট বিশাল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ‘‘কর্তব্য ভবন’’ হবে আধুনিকতার এক আদর্শ। এই ভবন গ্রীন বিল্ডিং মান অনুসারে তৈরি। এখানে সৌরশক্তি ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক আলো ও বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার, জ্বালানি-সাশ্রয়ী যন্ত্র, জল সংরক্ষণের জন্য বৃষ্টির জল সংগ্রহ ও গ্রে ওয়াটার পুনঃচক্রায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে বিদ্যুতের খরচে বিপুল সাশ্রয় হবে। অনুমান অনুযায়ী, ‘‘কর্তব্য ভবন’’ পুরোপুরি চালু হলে প্রতিবছর প্রায় ২৫–৩০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

কর্তব্য ভবনের উপযোগিতা
এলাকাটি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, সংসদ ভবন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় দপ্তরের একেবারে কাছাকাছি। এর ফলে প্রশাসনিক কাজের গতি বহুগুণ বেড়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, এতদিন মন্ত্রণালয়গুলি দিল্লির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল। এর কারণে সিদ্ধান্তে দেরি হতো, ফাইল চলাচলে সময় নষ্ট হতো এবং সমন্বয়ের সমস্যা দেখা দিত। ‘‘কর্তব্য ভবন’’ এই সমস্যার সমাধান করবে। কারণ এই কমপ্লেক্স হবে এক প্রশাসনিক মেরুদণ্ড। এখানে ৩০টিরও বেশি মন্ত্রণালয় ও তাদের ৫২টি শাখা একসঙ্গে কাজ করবে। এতে প্রশাসনে এক নতুন শক্তি প্রবাহিত হবে।

নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত সমন্বয় প্রয়োজন। এখন গুরুত্বপূর্ণ কোনও প্রস্তাব আলোচন, পরামর্শ ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় দেরি না হয়ে দ্রুত সম্পন্ন হবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কাছাকাছি অবস্থানও এক বড় সুবিধা হবে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন, নিয়মিত বৈঠক করবেন এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ সম্ভব হবে। মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বারবার যাতায়াত করতে হতো, এখন আর তা লাগবে না। সংসদ ভবনের নিকটে অবস্থিত ‘‘কর্তব্য ভবন’’ প্রশাসন ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সমন্বয় আরও সহজ করবে। সবকিছু এক জায়গায় হওয়া শুধু সুবিধা নয়, বরং এক সুদূরদর্শী ও কৌশলগত প্রয়োজন। ‘‘কর্তব্য ভবন’’ হয়ে উঠছে ভারতের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার কেন্দ্র।

ভবিষ্যতের ভারতঃ যুব প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা ভারত
আজকের ভারত মহাকাশে নতুন উচ্চতা স্পর্শ করছে, ডিজিটাল বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং উদ্যোগের পথ প্রসারিত করছে। এমন ভারতের রাজধানীতে দাঁড়িয়ে থাকা ‘‘কর্তব্য ভবন’’ হবে সেই নতুন ভারতের দৃশ্যমান প্রতীক, যে ভারতের স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেখিয়েছেন।

এই ভবনের ভিত্তি টিকে আছে সুদূরদর্শিতা, সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও নৈতিকতার উপর। এ–ই সেই আদর্শ, যা আচার্য চাণক্য ‘‘অর্থশাস্ত্র’’-এ ‘‘সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্র’’ তত্ত্বের মাধ্যমে প্রতিপাদন করেছিলেন। সাত অঙ্গ—রাজা, মন্ত্রী, জনপদ, দুর্গ, কোষ, শিক্ষা ও মিত্র—যে কোনও রাষ্ট্রের স্থিতি ও শক্তির ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। ‘‘কর্তব্য ভবন’’ এই সব উপাদানের আধুনিক, সমন্বিত ও শক্তিশালী রূপ। মোদিজির এই স্বপ্ন হলো, শাসন যেন কেবল দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও সহযোগিতার এক জীবন্ত সংস্কৃতি তৈরি করে। ‘‘কর্তব্য ভবন’’ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

Read More News

মজবুত ভারত, বুলন্দ ইরাদে

সকাল সকাল ডেস্ক। -ঋতুপর্ণ দেবে লালকেল্লার প্রাচীর থেকে টানা ১২তম বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর...

Read More